বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যা ও সমাধান: বর্তমান চিত্র, চ্যালেঞ্জ এবং করণীয়
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার চিত্র:
সাফল্যের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ত্রুটিগুলো বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থার মূল ভিত্তি। জাতীয় শিক্ষানীতিতে এই পর্যায়কে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, কারণ এখানেই শুরু হয় একটি শিশুর আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন। সরকারের নানা উদ্যোগ এবং উন্নয়ন প্রকল্পের ফলে আজ গ্রাম-গঞ্জেও স্কুল রয়েছে, বই পাওয়া যায় বিনামূল্যে, এবং শিক্ষার্থীভাতা চালু হয়েছে। কিন্তু এর মাঝেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি রয়েছে, যেগুলো দূর করা না গেলে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন অর্জন কঠিন।
মানসম্পন্ন শিক্ষকের ঘাটতি
বর্তমানে অনেক শিক্ষক নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও মানসম্পন্ন শিক্ষকের সংখ্যা এখনও পর্যাপ্ত নয়। বেশিরভাগ শিক্ষকই আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতির সাথে পরিচিত নন এবং অনেকেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন। ফলে শিক্ষার্থীরা মুখস্থ নির্ভর পড়াশোনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে, যা তাদের সৃজনশীলতা ও বিশ্লেষণ ক্ষমতার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে।
পাঠ্যবই এবং পাঠদান পদ্ধতির দুর্বলতা
পাঠ্যবইগুলো জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুযায়ী হলেও, অনেক ক্ষেত্রেই বইয়ের ভাষা শিশুদের বোধগম্য নয়। এতে করে শিশুরা বই পড়ায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তদ্ব্যতীত, শিক্ষকরা মূলত বই পড়িয়ে যান, কিন্তু পাঠদান পদ্ধতিতে ইন্টার্যাক্টিভ পদ্ধতির ব্যবহার খুবই কম, ফলে ক্লাসগুলো হয়ে ওঠে একমুখী ও নীরস।
শ্রেণিকক্ষের সংকট ও অবকাঠামোর দুর্বলতা
একটি বড় সমস্যা হলো পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, বেঞ্চ ও মৌলিক অবকাঠামোর অভাব। অনেক স্কুলেই শিক্ষার্থীর সংখ্যা অতিরিক্ত, কিন্তু শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক যথেষ্ট নয়। এতে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় মনোযোগ পায় না এবং শিক্ষার মানও হ্রাস পায়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের অনেক স্কুলেই এখনো খোলা আকাশের নিচে ক্লাস নিতে হয়।
প্রযুক্তির ব্যবহার নেই বললেই চলে
বর্তমান বিশ্বে শিক্ষা প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ডিজিটাল বোর্ড, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস কিংবা ইন্টারনেটের ব্যবহার এখনো সেভাবে শুরু হয়নি। এতে করে শিক্ষার্থীরা আধুনিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং শহর-গ্রামের মধ্যে একটি বড় ব্যবধান তৈরি হচ্ছে।
পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষা ও সৃজনশীলতার অভাব
প্রাথমিক স্তরে এখনো মূলত পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতি বিদ্যমান। অভিভাবকরাও সন্তানের রেজাল্ট ভালো হলে খুশি হন, অথচ শিশুর মৌলিক বোধ বা সৃজনশীল বিকাশের দিকে নজর দেওয়া হয় না। এতে শিশুরা নিজে থেকে চিন্তা করতে শেখে না, বরং মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাস করাই তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
সম্ভাব্য সমাধান ও করণীয়
প্রথমত, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর জন্য নিয়মিত ওয়ার্কশপ ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, পাঠ্যক্রমে শিশুবান্ধব, বাস্তবঘনিষ্ঠ ও ইন্টার্যাক্টিভ উপাদান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তৃতীয়ত, প্রত্যন্ত এলাকায় ডিজিটাল ক্লাসরুম ও ইন্টারনেট সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, যেন শহর ও গ্রামের মধ্যে পার্থক্য কমে আসে।
সবশেষে, মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন জরুরি—মুখস্থ নির্ভরতা বাদ দিয়ে প্রজেক্ট ভিত্তিক, আলোচনা নির্ভর ও শিশুদের অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতির মাধ্যমে মূল্যায়ন চালু করতে হবে।
শেষ কথা
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা খাতে অনেক অগ্রগতি হলেও, গুণগত মানের অভাব এখনো স্পষ্ট। শুধুমাত্র পরিমাণগত সাফল্য দিয়ে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। সময় এসেছে ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে একটি টেকসই ও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
No comments