বাংলা সাহিত্যের দুঃখ !!!!!

বাংলা সাহিত্যের দুঃখ : মাইকেল মধুসূদন দত্ত?

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ।picture
মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বাংলা সাহিত্যে প্রবল প্রতাপশালী মহাকবি। বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের মহানায়ক। ১৮২৪ সালে ২৫ জানুয়ারি তিনি যশোরের সাগরদাঁড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ২৯ জুন ১৮৭৩ সালে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
‘বাংলা সাহিত্যের তিন প্রধান দুঃখ। ১.মধুসূদনের বেদনার্ত মৃত্যু ও মাত্র আট বছরের সাহিত্যজীবন, ২.নজরুল পুরো জীবনের অর্ধেকই বাকরুদ্ধ ও বোধহীন এবং৩. সুকান্ত জীবনকে বোঝার আগেই জীবন থেকে বিদায় নিয়েছেন। সেকারণে এই তিন কবি বাংলার জন্য বিরাট এক দুঃখ হয়েই রইলেন।’ এই অভিধাটিই মূলত এই প্রবন্ধটি তৈরির মূল অনুপ্রেরক-শক্তি। বাংলা সাহিত্যে হাতেগোনা যে কয়েকজন প্রধান কবি-তন্মধ্যে অন্যতম প্রধান কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি একক চেষ্টায় বাংলা সাহিত্যকে অসামান্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কবিতার বাঁক পরিবর্তন করে কবিতার রাজ্যে নিজের স্থায়ী রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তাঁর সাহিত্য জীবন মাত্র আট বছরের মতো। এই স্বল্প সময়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যকে যে পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন, অবদানের বিবেচনায় তাঁর সঙ্গে এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যতিত আর কোনো নাম উল্লেখে আসে না। মধুসূদন দত্তের সাহিত্য যেমন আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ আগ্রহের, ঠিক একইভাবে তাঁর বোহীমিয়ান ও ছন্দহীন জীবনের করুণ পরিণতি ও দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুও আমাদেরকে বিশেষভাবে ব্যথিত করে। মধুসূদন যদি দারিদ্রপীড়িত না হতেন, হতাশার অন্ধকারে মাত্র ঊনপঞ্চাশেই জীবনকে শেষ করে না দিতেন, বাংলা সাহিত্য যে তাঁর হাত ধরে আরো বহু পথ পেরেুতে পারতো, তাতে বাংলা ভাষার সম্মান ও মর্যাদা আরো অনেক বেশি হতো, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
ট্রাজেডি জীবন গ্রহণ করে স্বল্পসময় সাহিত্য সাধনা করে গোটা বিশ্বকে বিস্মিত করে গেছেন- বিশ্বসাহিত্য ইতিহাসেও এ রকম দৃষ্টান্ত কম নয়। এ সব লেখকদের অধিকাংশেরই সাহিত্য ও ট্রাজেডি জীবন পাঠকের কাছে সমান আগ্রহের বিষয়।পৃথিবী খ্যাত অধিকাংশ সাহিত্যিকের পরিণতি প্রায় একই রকম ট্রাজিক। আমাদের মধুসূদন-নজরুল-সুকান্তের ভয়াল পরিণতি সে-সব পরিণতির সঙ্গে দারুণ রকমের মিল রয়েছে। স্বভাব কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস ও কবি আবুল হাসানের মৃত্যুও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। ইডিপাস যেভাবে নিজেকে মুক্ত করার জন্য দৃঢ়তায় পথ খুঁজেছেন, কিন্তু নিয়তি তাঁকে প্রতিক্ষেত্রেই বেঁধে ফেলেছে, নির্মম পরিণতির দিকেই এগিয়ে নিয়ে গেছে। মধুসূদন তো কতোভাবেই চেষ্টা করে নিজেকে সম্মান ও যশে এবং অবশ্যই অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। সারা পৃথিবী প্রায় চষে বেড়িয়েছেন। নিয়তি তাঁকে বারবারই ব্যর্থতার স্বরলিপি লিখে দিয়েছে। নজরুলতো বিয়াল্লিশ বছর থেকে ছিয়াত্তর পর্যন্ত বাকরুদ্ধ ও বোধহীন হয়ে মৃত্যুসমান হয়ে বেঁচে থাকলেন। সুকান্ত জীবন বোঝার আগেই হারিয়ে গেলো। পোস্ট-ইমপ্রেশানিস্ট গগ্যাঁ অসহ্য দারিদ্রের মধ্যে তিনি জীবন কাটিয়েছেন। কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে অবর্ণনীয় এক মৃত্যুর শিকার হয়েছিলেন। ভ্যান গঘ মৃগীরোগে উম্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। পাগলা গারদে তাঁর ঠিকানা হয়। পাগলা গারদে থাকা অবস্থায় তিনি আত্মহত্যা করেন। বিশ্ব-কিংবদন্তির নায়ক হোমার অন্ধ ছিলেন বলে অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করেন। বিখ্যাত হোমার ভিক্ষে করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ভয়াবহ দুর্বিষহ জীবনের শিকার ছিলেন। মিল্টন অন্ধ ছিলেন। এ জন্যে তাঁর আপন ভাইয়েরা তাঁকে তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের সহ গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিল। যাঁদের একদিন তিনি নিজে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নিজের শ্রমে অর্জিত অর্থ দিয়ে। অন্ধ হওয়ার পর পরিবারের আপনজনদের কাছ থেকে তিনি চরম নির্দয় ও নিষ্ঠুর আচরণের শিকার হন। অপরিসীম বেদনা নিয়েই তিনি লেখনি ধারণ করেছিলেন। দান্তেকে নিজের নগরী থেকে নির্বাসিত করা হয়েছিল। বিদেশ-বিভূঁইয়ে দিনাতিপাত করেছেন।
নিজের মাতৃভূমিতে আর কোনোদিন তিনি ফিরে যেতে পারেননি। সারভানটিসকে শেকসপীয়রের সমতুল্য প্রতিভা মনে করা হতো। তাঁর জীবনও ছিল ভয়াবহ বেদনাময়। ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে তিনি যুদ্ধে যোগ দিতে গিয়ে নিজের একটা হাত হারিয়ে ফেলেন। এর পর আলজিরিয়ায় তাঁকে দীর্ঘকাল বন্দিজীবন কাটাতে হয়। দীর্ঘ বন্দিজীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে এলেও সম্মানজনক জীবন তিনি পাননি। নিজের দেশেই নিজের জীবন নিয়ে তিনি কখনো স্বস্তিবোধ করেননি। আর্মাডার জন্য গম আদায়ের চাকরি নিয়েছিলেন তিনি। সেখানে হিসেব না মেলায় তাঁকে আটবার জেল খাটতে হয়েছে। এখানেই শেষ হয় নি তাঁর জীবনের ট্রাজেডি। মানুষ হত্যার অভিযোগেও তাঁকে অভিযুক্ত হতে হয়েছিল। আধুনিক রুশ সাহিত্যের জনক পুশকিন ও দীর্ঘজীবন পাননি। মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে প্রাণ হারান তিনি। দস্তয়েভস্তি যে জীবন কাটিয়েছেন, তাতে কোনো সম্মান ছিল না। মৃগিরোগ-অর্থাভাব-রাজনীতিক নিগৃহ- এনসব নিয়ে এক ধীকৃত জীবন ছিল তাঁর। রাজনৈতিক কারণে তাঁর ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। জারের কৃপায় বেঁচে যান একেবারে শেষ মুহূর্তে। এর পর তাঁকে পাঠিয়ে দেয়া হয় সাইবেরিয়ায়। সেখানে দশ বছরের কারাজীবনে অসহনীয় নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। নোবেল বিজয়ী ঔপন্যাসিক ন্যুট হামসুন দারিদ্রের অভিশাপে দুর্বিষহ জীবনযাপন করেছেন। ম্যাক্সিম গোর্কি দারিদ্রের বিভীষিকা সহ্য করতে না পেরে একসময় অাত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। এঁদের সঙ্গে শার্ল বোদলেয়ার, মায়াকোভস্কি, কীটস কিংবা গুস্ত্যাব ফ্লবের-এরকম আরো অনেক নাম উচ্চারণ করা যাবে, যারা নিজেদের জীবনকে কোনোদিন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন নি। নিজের আয়ুকে নিজেই যেন ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। অগ্রহণযোগ্য জীবন বেছে নিয়েছিলেন-উচ্চাকাঙ্ক্ষা, গভীর প্রণয়-দূরারোগ্য ব্যাধি- এর কোনোটি না কোনোটি তাঁদের জীবনে মরণ তীর হয়ে বিঁধেছিল। মরণের আগমনীপথ নিজেরা রচনা করেই মরণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্বল্প সময়ে যে সাহিত্যকীর্তি তারা করে গেছেন, যা অমূল্য তো বটেই, কালোত্তীর্ণ এবং অবশ্যই চিরকালের। বিশ্বসাহিত্যে যে ক’জন লেখক বা কবির জীবন ট্রাজেডিপূর্ণ, বাঙালি কবি মধুসূদন তাঁদেরই অন্যতম প্রধান হিসেবে অন্তর্ভূক্ত।
মধুসূদন দত্ত ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব রাজনারায়ন দত্তের সন্তান। যশোরের সাগরদাঁড়িতে বাড়ি। মধুসূদন দত্ত বিত্ত-বৈভবের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। কিন্তু বাল্যবয়স থেকেই তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল আকাশছোঁয়া। তাঁর চালচলন-পোশাক-পরিচ্ছদ- সবকিছুতেই ছিল ইংরেজি ধাঁচ। বাঙালি সন্তান হয়েও ইংরেজির প্রতি ছিল বিশেষ দুর্বলতা, ইংরেজিতে তিনি অসাধারণ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। আর বিখ্যাত হতে চেয়েছিলেন ইংরেজি সাহিত্যে। তাঁর জীবনের হিসেবের অংক এখান থেকে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠতে থাকে। কলকাতায় হিন্দু কলেজে অধ্যয়ন করেছেন। কবি হওয়ার স্বপ্নবাস্তবায়নের জন্য নিজের ধর্ম ত্যাগ, খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ, হিন্দু কলেজ ছেড়ে বিশপস কলেজে ভর্তি- এসবের মূলে ছিল তাঁর কবি হওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। কারণ খ্রিস্টান হয়ে বিলেতে যাওয়া সহজ। সেখানে গিয়ে বিশ্বখ্যাত কবিদের সান্নিধ্য অর্জন এবং নিজেকেও ইংরেজি সাহিত্যে বিখ্যাত কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা- এসব স্বপ্ন তখন মনোভুমিতে দৃঢ়তর বীজ বপন করেছে। ‘প্রথম যৌবনে তিনি যে অংশত কবি হবার আশায়, অংশত আয়োজিত বিয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে এবং অংশত বিলেত যাবার পথ প্রশস্ত হবে মনে করে (সাধিতে মনের সাধ) খৃস্টান হয়ে বাবা-মাসহ সমস্ত আপনজন স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছিলেন…। সত্যি বলতে কি এই এক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তিনি নিজের শেকড়ও ছিন্ন করেছিলেন আজন্মেও একান্ত আপন পতিবেশ থেকে।’ এ কারণে মধুসূদনকে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। পিতার সঙ্গে তাঁর স্বাভাবিক সম্পর্ক আর কোনোদিনই স্থাপিত হয়নি। এ থেকে তাঁর মধ্যে অসামান্য হতাশা ও নিঃসঙ্গতা তৈরি হয়েছিল। বিদেশি সাহিত্য পাঠের ভেতর দিয়ে তিনি যে নীলনয়না তন্বীর জন্য তিনি যে নিজের মানসভূমি তৈরি করেছিলেন, তাঁকে পাবার তীব্র আকুতি এবং ‘ইংরেজ’ কবি হওয়ার দুর্মর বাসনায় তিনি আপনজনদেরও থেকে যোজন যোজন দুরে সরে গিয়েছিলেন। এসবও এক সময় তাঁর মধ্যে কঠিন বেদনা তৈরি করেছিল। চাপা স্বভাবের মধুসূদন ব্যক্তিগত সে-সব বিষয় নিজের ভেতরই রাখতেন। কবিতায় তা ফুটে উঠেছে নানামাত্রিকতায়। মধুসূদন বাল্য থেকেই বিদ্রোহী মনোভাবের ছিলেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সাহিত্যসৃষ্টি সকল ক্ষেত্রেই ঘটেছে। গতানুগতিক জীবনধারাকে তিনি কখনোই গুরুত্ব দিতেন না। যেকারণে তাঁকে অনেকেই অন্যগ্রহের মানুষ বলে মনে করতেন।
মেধাবী বলতে যা বোঝায় মধুসূদন দত্ত তার থেকেও বেশি কিছু ছিলেন। আভিজাত্যের ভেতর বেড়ে ওঠা মধুসূদন কোনোদিন দারিদ্র কী তা অনুধাবন করেন নি। বন্ধুদের দু’হাত ভরে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। কাউকে টাকা দেবার সময় তিনি তা গুণেও দিতেন না। সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রেও ছিলেন প্রবল খরস্রোতা নদীর থেকেও তীব্র। কপোতাক্ষ নদের তীব্র স্রোতই হয়তো তাঁর সৃষ্টিধারাকে প্রবলকরে তুলেছিল। ‘সৃষ্টির নেশা যখন তাঁর ওপর ভর করতো, তখন তিনি ধীরে-সুস্থে লিখতে পারতেন না। যা কিছু লেখার ঝড়ের গতিতেই লিখতেন।’ মধুসূদন নিজেও তাঁর সৃষ্টির গতি সম্পর্কে বলেছেন, ‘ধীমা তাল আমার তাল নয়, যা লিখবো ঝটপট লিখে ফেলবো।’ তাঁর ‘ক্যাপটিভ লেডি’, ‘শর্মিষ্ঠা’ থেকে শুরু করে অন্যন্য রচনাগুলোর সময়কাল হিসাব করলেই এ সত্যতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু তাঁর বোহেমিয়ান জীবন, আর্থিক দৈন্য, পারিবারিক জীবনে সংকট, পেশাগত জীবনে প্রতিষ্ঠা না-পাওয়া, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত এবং অস্বাভাবিক মদ পান- তাঁর সৃজনশীল সৃষ্টিকে খুন করে ফেলেছিল। যে কারণে ঊনপঞ্চাশ বছরের জীবনে সাহিত্যসৃষ্টিতে তিনি খুব কম সময়ই সাহিত্য সাধনায় ব্যয় করতে পেরেছিলেন। কিন্তু স্বল্পসময়ে তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। তিনি কখনো নিয়মতান্ত্রিকভাবে জীবনকে দেখেননি। কোনো বিধি-নিষেধের ভেতর জীবনকে আবদ্ধ করেননি। স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারি স্বভাবের ভেতরই জীবনকে তিনি চালিত করেছেন। ফলে জীবনের প্রতি বাঁকে বাঁকে নতুন নতুন দুঃখ-কষ্ট তাঁকে অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরেছে। যা ক্রমশ ব্যাপক থেকে ব্যাপক, গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে- অনিশ্চিত ও ভয়াবহ এক জীবনের দিকেই তাঁর জীবন ধাবিত হয়েছিল। যেখান থেকে তিনি কখনো নিজের মুক্তি ঘটাতে পারেননি। অনিবার্য করুণ এক পরিণতিই তাঁকে মেনে নিতে হয়েছিল।
দাম্পত্যজীবনেও মধুসূদন সমাজ-রীতি, নীতি-নৈতিকতা গ্রাহ্যে আনেননি। রেবেকার সঙ্গে তাঁর যে জীবন ছিল, প্রথমদিকে সে জীবন শান্তি ও তৃপ্তিকর ছিল। চারটি সন্তানের জনক-জনকী ছিলেন রেবেকা এবং তিনি। ‘আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য না-থাকলেও, তাঁর পারিবারিক জীবন বেশ সুখের এবং পরিতৃপ্তির ছিল। রেবেকাও কবিকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন বলেই তিনি সবার বিরোধিতা সত্ত্বেও মাইকেলকে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের পর তিনি দারিদ্র, রুগ্নতা, পরপর সন্তানধারণ, স্বামীর বোহীমিয়ান জীবনযাত্রা সবকিছুই সহ্য করেছেন।..কবির ভালোবাসা পেয়ে তিনি আর সব কিছু তুচ্ছজ্ঞান করেছিলেন। স্ত্রীকে নিয়ে কবি মাদ্রাসে কপোত-কপোতীর মতো প্রেমঘন নীড় গড়ে তুলেছিলেন। অবাক হওয়ার মতো ঘটনাা এমন প্রেমপূর্ণ সংসার মধুসূদন দত্ত নিজেই ত্যাগ করেছিলেন। মাদ্রাস ত্যাগ করার পর রেবেকোর সঙ্গে অর্থাৎ পরিবারের সঙ্গে তাঁর চিরদিনের মতো সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। মধুসূদনের এরকম বিশ্বাসঘাতকতা রেবেকা কখনো ভুল করেও কল্পনা করতে পারেননি। ফলে রেবেকো অসম্ভবরকম আহত হয়েছিলেন। হেররিয়েটার সঙ্গে মধুসূদনের যে গোপন প্রণয় ছিল, মধুসূদন সেটাও কারো সঙ্গে প্রকাশ করতে পারতেন না। সে কারণে রেবেকার সঙ্গে দাম্পত্যজীবনের শেষের দু’বছর তিনি মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত ছিলেন। কারণ তখন তিনি হেনরিয়েটার সঙ্গে গোপন প্রণয়ে মত্ত। রেবেকোর সঙ্গে বাহ্যিক সম্পর্ক তখন থাকলেও, মনের ঘরে তখন পুরোটাই হেনরিয়েটা। রেবেকা কখনো ভাবতে পারেননি মধুসূদন তাঁর সঙ্গে এ রকমটি করতে পারেন। কিন্তু যখন মধুসূদন-হেনরিয়েটার গোপন প্রণয়ের ব্যাপারটি প্রকাশ হয়ে পড়ে, তখন তিনি রেবেকার কাছে বিব্রত হয়েছেন, ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব সকলের কাছে নিজের সম্মান হারিয়েছিলেন। রেবেকা এবং চারটি সন্তানকে রেখে হেনরিয়েটার সঙ্গে তাঁর নতুন জীবন-তাঁর বহু কাঙ্ক্ষিত নীলনয়না তরুণী লাভ ঘটলেও, ভেতরে তাঁর এক প্রবল পাপবোধ তৈরি হয়েছিল, তৈরি হয়েছিলো অসহনীয় অনুশোচনা।
রেবেকার সঙ্গে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন যেমন আর্থিক-স্বচ্ছন্দ্যময় ছিলো না, একই অবস্থা ঘটে হেনরিয়েটার সঙ্গেও। হেনরিয়েটা পিতা-মাতা, নিকটাত্মীয় সকলকে ছেড়ে মধুসূদনের জন্য কলকাতায় চলে এসেছিলেন। মধুসূদন তাঁকে পেয়ে আবেগ আপ্লুত হয়েছিলেন, নতুন সৃষ্টিতে মেতে উঠেছিলেন ঠিকই, কিন্তু আর্থিক কষ্ট ঠিকই তাঁকে জাপটে ধরেছিলো। সেখান থেকে মুক্তির চেষ্টা যে মধুসূদন করেননি তা নয়। কিন্তু তাঁর চিরকালের বেহিসেবী জীবন কখনোই হিসাব মেলাতে পারেনি। ফলে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট-অপমান সহ্য করতে হয়েছে হেনরিয়েটাকে।
মধুসূদন ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য যখন লন্ডনে পাড়ি জমান-তাঁর দুচোখে তখন অনেক স্বপ্ন। নামকরা ব্যারিস্টার হবেন, খ্যাতি অর্জন করবেন, দুহাত ভরে অর্থ উপার্জন করবেন। হেনরিয়েটা আর সন্তানেরা নিশ্চিন্ত জীবন পাবে। বাস্তবে তা দুরাশাই থেকে গেছে। বিদ্যাসাগরের প্রেরণা ও অর্থ-সহযোগিতায় বহু কষ্টে ব্যারিস্টার তিনি হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর ‘ সাফল্যের দেখা-পাওয়া হয়ে ওঠেনি। দারিদ্রের আগুন থেকে তিনি রেহাই পাননি শেষ পর্যন্ত। ফলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে দিনদুপুরে ঘরের জানালা দরোজা বন্ধ করে অন্ধকারে অনবরত মদ পান করে আত্মহননের পথই যেনো তিনি বেছে নিয়েছিলেন। যে কারণে বাংলা সাহিত্যের প্রবল এক মেধাবী পুরুষের মৃত্যু ঘটে মাত্র ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে। মৃত্যুতেও কী শান্তি পেয়েছিলেন! সম্মান পেয়েছিলেন! চব্বিশ ঘণ্টা তাঁর প্রাণহীন শরীর পড়ে ছিলো অবহেলায়। ধর্ম সেখানেও ফণা তুলেছিলো।
মধুসূদনেরর অকাল এই অবসান এবং বাংলা সাহিত্যের প্রতি প্রথম থেকেই গভীর মনোযোগী না-হওয়া বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য বিরাট এক দুঃখ হয়েই রইলো। তিনি যে টুকু সময় পেয়েছিলেন, তা যদি বাংলা সাহিত্যের জন্য পুরোটা দিতেন, তা হলেও বাংলা সাহিত্য আরো অনেক বেশি সমৃদ্ধতর হতো। বাংলার দুঃখ তার থেকে বেশি যে জায়গাটিতে তা হলো, তিনি নিজেই নিজের জীবনের অন্ধকার তৈরি করেছেন এবং বলা যায় নিরবে নিভৃতে একরকম আত্মহননই করেছেন। বাংলায় এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কী আছে!
সুত্রঃ ইন্টারনেট

No comments

Theme images by konradlew. Powered by Blogger.